ভারতীয় সভ্যতার বিবর্তনে প্রাচীন ভারতের উপরে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার মেহেরগড় সভ্যতা সেই মেহেরগড় সভ্যতার উপরে আমরা ডিটেলসে আপনাদের কাছে তুলে ধরলাম ।
✓ প্রাচীন গ্রস্তর যুগ (Paleolithic Age) [সময়কাল: আনুমানিক ৪00000-200000 খ্রি. পূ.]
এই যুগকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করা হয়—নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগ, মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ এবং শেষতম প্রাচীন প্রস্তর যুগ।
১) নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুণ (The Lower Paleolithic Age)-এর নিদর্শন-(i) স্থান: কাশ্মীর অঞল (পূর্বে পাকিস্তানের সােয়ান অল—সােয়ান সংস্কৃতি), পাটোয়ার মালভূমি, হিমাচল প্রদেশের শিবালিক পর্বত, কর্ণাটকের হুগসি উপত্যকা, তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের নিকট অওরিপক্কম, রাজস্থানের দিদওয়ানা, মহারাষ্ট্রের নেভাসা, মধ্যপ্রদেশের নর্মদা উপত্যকায় এই যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
(ii) মানব প্রজাতি: হােমাে হাবিলিস বা হােমাে ইরেক্টাস।
(iii) হাতিয়ার: মূলত পাথরের তৈরি হাতিয়ার হাত কুঠার ও ‘চপার জাতীয় অস্ত্র। এই অস্ত্রগুলি নুড়িপাথর বা কোয়ার্টজাইট দিয়ে তৈরি হত। নিম্নমানের এই ভারী যন্ত্রপাতিগুলি ‘কোর টুল (core tool) নামে পরিচিত ছিল। কাশ্মীরের পহেলগাঁও অঞলে আজ থেকে প্রায় 5 থেকে ৭লক্ষ বছর আগের হাত কুঠার জাতীয় অস্ত্র মিলেছে।
(iv) খাদ্য: এই যুগের মানুষ মূলত খাদ্য সংগ্রাহক ছিল। শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ করে জীবনধারণ করত। সেই সময়কার মানুষ পশুপালন জানত না।
(v) বাসস্থান: এই সময়কার মানুষ খােলা আকাশের নীচে বা প্রাকৃতিক গুহায় বসবাস করত। কর্ণাটকের কুর্নল, পাকিস্থানের সাংঘাও, মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকায় প্রাচীন বাসস্থানের নিদর্শন মিলেছে।
২) মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ (The Middle Paleolithic Age)-এর নিদর্শন-(i) হাতিয়ার: এই পর্বে ব্যবহৃত প্রধান অস্ত্রগুলি ছিল ছুরি (Blade), ছুরিকা (Bladelet), বুরিন (বিদ্ধ করার অস্ত্র) প্রভৃতি।
(ii) স্থান: অস্ত্রগুলির নিদর্শন (মূলত ফ্লেক জাতীয়) পাওয়া গেছে মহারাষ্ট্রের নেভাসাতে, রাজস্থানের দিদওয়ানাতে (আনুমানিক 57000 বছর পূর্বে)।
৩) পরবর্তী বা শেষতম প্রাচীন প্রস্তর যুগ (The upper Paleolithic Age)-এর নিদর্শন—(i) এই পর্বে ফ্লেক দ্বারা প্রস্তুত ছুরি জাতীয় যন্ত্রপাতির প্রভাব বজায় ছিল।
(ii) প্রাচীন প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়ে ব্লেড ও বুরিনের পাশাপাশি ছাঁচার জন্য অস্ত্র, চন্দ্রাকৃতি অস্ত্র ও অন্যান্য ক্ষুদ্র হাতিয়ারের ব্যবহার শুরু হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই পর্যায়ে নিগ্রো জাতিগােষ্ঠীর প্রাধান্য ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
✍️মধ্যপ্রস্তর যুগ (Mesolithic Age) [সময়কাল: আনুমানিক 10000-6000 খ্রি. পূ.]
১) হাতিয়ার: এই সময় ক্ষুদ্র অস্ত্র বা Microlithic হাতিয়ারের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। এই যুগকে তাই Microlithic' যুগও বলা হয়ে থাকে। এগুলির মধ্যে হাড়ের তৈরি ফলা, ধারওয়ালা ছুরি, জাঁতা জাতীয় উপকরণ ছিল উল্লেখযােগ্য।
২) মানবগােষ্ঠী: ভারতের পূর্বে বসবাসকারীরা ছিল প্রধানত মােঙ্গল বংশােদ্ভূত এবং পশ্চিমে বসবাসকারীরা ছিল ককেশীয় জাতিগােষ্ঠীভুক্ত।
৩) নিদর্শন:গুজরাটের লঙ্খঞ্জ, মহারাষ্ট্রের চলিসগাঁওয়ের কাছে পাটন (28,000 বছরের পুরানাে হাতিয়ার), উত্তরপ্রদেশের সরাই নহর রাই, মাহাদহা, চোপানি মান্ডাে, মধ্যপ্রদেশের আদমগড়, রাজস্থানের বাগােড় পাচপদ্ৰ উপত্যকা ও সােজাট অঞ্চলে এবং দক্ষিণে তিনেভেলি প্রভৃতি স্থানে এই যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
৪) জীবিকা ও পশুপালন: এই যুগের প্রধান জীবিকাগুলি ছিল—পশুশিকার, পশুপালন, মাছ ধরা, ফলমূল সংগ্রহ এবং কৃষিকাজ (শেষভাগে)। ভেড়া, ছাগল, হরিণ, শূকর, গন্ডার, হাতি, কচ্ছপ ইত্যাদি পশুর হাড় থেকে এগুলির অস্তিত্ব ছিল বলে অনুমান করা হয়। এই যুগে মৃৎশিল্পের নিদর্শন পাওয়া গেলেও কুমােরের চাকার ব্যবহার ছিল না।
✍️নব্যপ্রস্তর যুগ (Neolithic Age) [সময়কালঃ আনুমানিক 6000-2500 খ্রি. পূ.]
১) অস্ত্র বা হাতিয়ার পূর্বের তুলনায় মসৃণ ও চকচকে পাথরের তৈরি অস্ত্রের ব্যবহার করা হত।
২) বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শন: এই যুগের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল— গৃহ নির্মাণ, কৃষিকাজে উন্নতি ও পশুপালন, সুতাে কাটার চরকা, মাটির পাত্র ও তুলাে থেকে সুতাে তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার, তামা ধাতুর সঙ্গে মানুষের পরিচয় ইত্যাদি। কাশ্মীরের বুর্জহােমে প্রথম এই যুগের মানুষদের সমাধিস্থ করার নীতি সম্পর্কে নির্দশন পাওয়া যায়। এখানে গৃহপালিত পশুদের তাদের প্রভুর সাথে কবর দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। মেহেরগড়ে কুমােরের চাকা ও আগুনের ব্যবহারের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড এই যুগকে 'নব্যপ্রস্তর যুগীয় বিপ্লব’ (Neolithic Revolution) বলে আখ্যা দিয়েছেন।
✍️তাষ-গ্রস্তর যুগ (Chalcolithic Age) [সময়কাল: 2000/1800-1000 খ্রি. পূ.)
১) এই সময়ে মানুষ পাথরের সঙ্গে তামার ব্যবহার এবং তামার সঙ্গে টিন মিশিয়ে ব্রোঞ্জ তৈরির পদ্ধতি শেখে। এই যুগের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল জিনিসপত্র ও যন্ত্রপাতি নির্মাণে তামা ও কাঁসা উভয়ের ব্যবহার।
২) এ সময় বিভিন্ন সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। যেমন— (ক) কাথিয়াবাড়ের কাছে বানাস নদীর তীরে বানাস সংস্কৃতি (2000-1400 খ্রি.পূ.) গড়ে ওঠে। একে অহার সংস্কৃতিও বলা হয়ে থাকে।
(খ) চম্বল নদী ও এর শাখানদীর তীরে কায়াথা সংস্কৃতি (2000-1800 খ্রি.পূ.) গড়ে উঠেছিল।
(গ) নর্মদা ও এর শাখানদীর তীরে মালয় সংস্কৃতি (1700-1200 খ্রি.পূ.) (গুজরাটে) গড়ে উঠেছিল। এ ছাড়া উল্লেখযােগ্য সংস্কৃতির নিদর্শন ছিল চিরান্দ সংস্কৃতি (খ্রি.পূ. অষ্টম শতক) ও বংপুর সংস্কৃতি (1400-900 খ্রি.পূ.)।
৩) জীবিকা: কৃষিকাজ এই সময়ের প্রধান জীবিকা ছিল। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে ধান, গম, কলাই বা মটরশুটি ছিল অন্যতম।
৪)শিল্প ও যন্ত্রপাতি: বয়নশিল্প ও মৃৎশিল্প (লাল কালাে বর্ণের)-এর নিদর্শন পাওয়া গেছে। যন্ত্রপাতির মধ্যে তামার জিনিস, বাটালি, হরপুণ, কুঠার ইত্যাদি ছিল উল্লেখযােগ্য।
৫) অন্যান্য বৈশিষ্ট্য: মানুষ এসময় মাটি, কাঠ ও পােড়ামাটির তৈরি বাড়ি নির্মাণ শেখে। ষাঁড় ও মাতৃদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল। এসময় থেকে মানুষের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই ও শােষণ শুরু হয়।
🛑মেহেরগড় সভ্যতা:
সময়কাল: খ্রিস্টপূর্ব 7000 থেকে 2000 খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত (নিওলিথিক যুগ)।
আবিষ্কার:1974 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিশেষজ্ঞ জাঁ ফ্রাঁসােয়া জারিজ ও রিচার্ড মিডাে বেলুচিস্তানের পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকার কাচ্চি সমভূমিতে এই সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
গৃহপালিত পশু:ছাগল, ভেড়া, কুঁজবিশিষ্ট ষাড়কে পশুপালনের জন্য ব্যবহার করা হত।
কৃষিজ ফসল: গম, যব, বার্লি, খেজুর, তুলাে এবং জুজুব প্রভৃতি শস্যের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এখানে প্রাপ্ত পােড়া তুলাের বীজ থেকে প্রমাণ হয় যে, এসময়ের মানুষেরা সুতিবস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিল। এটি ভারতে কাপাস তুলা চাষের প্রাচীনতম নিদর্শন বলে মনে করা হয়।
ব্যাবসাবাণিজ্য: আফগানিস্তান, পশ্চিম এশিয়া, ইরান ও মেসােপটেমিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন চলত।
বাড়িঘর:রােদে শুকোনাে ইট দিয়ে বেশিরভাগ দুই-তিন কামরার বাড়ি তৈরি করা হত।
শস্যাগার:খাদ্যশস্য সঞ্চয়ের জন্য স্বতন্ত্র শস্যাগারের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
স্থাপত্য শিল্প:একটি বৃহদাকার ইটের তৈরি মঞ্চ ও প্রলেপযুক্ত দেওয়াল বড়মাপের স্থাপত্য নিদর্শনের পরিচায়ক। এইসময়ে পাথরে তৈরি জাঁতা ও পেষণের উপকরণ দেখা গেছে। কৃষি যন্ত্রপাতির মধ্যে প্রাচীনতম হাতিয়ারটি ছিল বিটুমেন জাতীয় পাথরখণ্ডে নির্মিত কাস্তে।
সিলমােহর:পাথর, হাড় ও পােড়ামাটির তৈরি, গােলাকার কিংবা আয়তাকার জ্যামিতিক নকশাযুক্ত বিভিন্ন নামমুদ্রা ও সিলমােহরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় যা প্রশাসনিক ও ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত।
অন্যান্য সামগ্রী:ছােটো ছােটো মানুষের মুর্তি, কুঁজবিশিষ্ট ষাঁড়, হাড়ের তৈরি সুঁচ, নীলকান্তমণি, বৈদূর্যমণি, লাপিস লাজুলি (এক ধরণের নীলা), ছােটো ছােটো ঙ্খ বিভিন্ন পাথর দ্বারা নির্মিত অলংকার, সামুদ্রিক প্রাণীর খােলস, প্রভৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়।

No comments:
Post a Comment